বাংলাদেশের আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সদস্যরা রাষ্ট্রের প্রতিটি সংকটে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে কাজ করে দেশের দুর্গাপূজার নিরাপত্তায়, কখনো জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র পাহারায়, কখনো আবার দুর্যোগে আটকে পড়া মানুষের পাশে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই বাহিনীর লাখো সদস্য আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, নিয়মিত বেতন-ভাতা, এমনকি নুন্যতম সম্মান থেকেও বঞ্চিত। রাষ্ট্র তাদের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু রাষ্ট্রের সেই নির্ভরতার বিনিময়ে তাদের ভাগ্যে জোটে কেবল অবহেলা আর তাচ্ছিল্য।
বর্তমানে দেশে আনুমানিক ৬১ লাখ ভিডিপি সদস্য (পুরুষ ও মহিলা) ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা গ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা, টিকা কার্যক্রম, দুর্যোগ মোকাবেলা, রেললাইন পাহারা, চুরি-ডাকাতি প্রতিরোধ সহ জায়গায় সক্রিয়। কিন্তু তাদের পরিচয় এখনও “স্বেচ্ছাসেবক”, যেন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরের এক অস্থায়ী বলয়। এই বাহিনী ছাড়া রাষ্ট্রের মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়বে এটা প্রশাসনের সবাই জানে। তবুও তাদের প্রাপ্যটুকু দিতে রাষ্ট্রের যেন বুক সংকুচিত হয়ে যায়। বড় বড় দপ্তরে বসে থাকা অনেক কর্মকর্তা এমনকি কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও ভিডিপিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, যেন তারা কোনো গুরুত্বহীন বাহিনী। অথচ সত্য হলো এই ভিডিপিরাই রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড, সংকটের সময় জনগণের শেষ ভরসা। শরদীয় দুর্গাপূজার সময় মণ্ডপে টানা কয়েকদিন ধরে রাত জেগে পাহারা দেন ভিডিপি সদস্যরা। নির্বাচন এলেই তারা মাঠে নামেন কেন্দ্র পাহারা, ভোটার নিরাপত্তা, এমনকি ভোট সরঞ্জাম পরিবহনেও দায়িত্ব নেন। রেলের নিরাপত্তা, দুর্যোগের সময় উদ্ধার অভিযান সবখানে তাদের দেখা যায়। কিন্তু কাজ শেষে তারা ফিরে যান নিরবেই, কারণ কোনো নিয়মিত বেতন নেই, নেই নির্দিষ্ট ভাতা, নেই পেনশন, নেই চিকিৎসা বা বীমার নিশ্চয়তা। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের অনেকেই দুর্ঘটনায় নিহত হন, আহত হন। কিন্তু রাষ্ট্রের রেকর্ডে তাদের মৃত্যু কেবল এক লাইনের রিপোর্টে সীমাবদ্ধ থেকে যায় “দায়িত্ব পালনকালে নিহত।
কোনো ক্ষতিপূরণ, কোনো পরিবারভিত্তিক সহায়তা কিছুই দেওয়া হয় না। অথচ দায়িত্ব পালনের আগে এই বাহিনীর জন্য বাজেট অনুমোদিত হয়; সেই টাকা কোথায় যায়, সেটাই এক বড় প্রশ্ন। ভিডিপি সদস্যদের বাস্তবতা আরও নির্মম। তারা সারা বছর নিজের পেশাগত কাজে ব্যস্ত থাকেন কেউ ছাত্র, কেউ শ্রমিক, কেউ দোকানদার। কিন্তু প্রশাসনের ডাকে সাড়া দিতে হয় হঠাৎ করেই। অনেক সময় চাকরির জায়গা থেকে ছুটি না পেয়ে তারা দায়িত্বে যান, আবার অনেকেই এই কারণে চাকরি হারান, সংসার ভেঙে পড়ে। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের কষ্ট বোঝে না শুধু দায়িত্ব চায়, দায়িত্ব শেষে নীরবতা। যাতায়াত, খাবার, থাকার সব খরচ তাদের নিজস্ব পকেট থেকে যায়। দায়িত্ব শেষে যখন সম্মানীর কথা আসে, তখন মাসের পর মাস ঘুরে বেড়াতে হয়, কখনো বছরও কেটে যায়। কেউ কেউ হতাশ হয়ে দায়িত্ব নেওয়া বন্ধ করে দেয়। অথচ প্রতিটি দায়িত্বের আগে বাজেট বরাদ্দ থাকে। কিন্তু মাঠপর্যায়ের ভিডিপিরা সেই বরাদ্দের দেখা পান না ফাইলেই শেষ হয়ে যায় তাদের পাওনা। এদিকে, যদি আন্তর্জাতিকের দিকে তাকানো যায়, দেখা যাবে “স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী” মানে অবহেলা নয় বরং সম্মানের প্রতীক।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গার্ড সদস্যরা প্রশিক্ষণকালীন বেতন পান, চিকিৎসা সুবিধা, পারিবারিক ভাতা, এমনকি শিক্ষা সুবিধাও পান। ভারতের হোমগার্ড সদস্যরা রাজ্য সরকারের নির্ধারিত মাসিক ভাতা ও ক্ষতিপূরণের আওতায় থাকেন। শ্রীলঙ্কার ভলান্টিয়ার ফোর্স সদস্যরা দীর্ঘমেয়াদি সেবার পর পেনশন ও বীমা পান। অথচ বাংলাদেশের ভিডিপি যাদের কাঁধে নির্বাচন, উৎসব, দুর্যোগ, গ্রাম্য নিরাপত্তা তারা বেতনহীন, বীমাহীন, মর্যাদাহীন অবস্থায় দিন কাটায়। তাদের ত্যাগের গল্প কেউ লেখে না, তাদের কণ্ঠ কেউ শোনে না। এই বাহিনীর সদস্যরা শুধু কাজের সময়ই রাষ্ট্রের অংশ, দায়িত্ব শেষ হলে তারা যেন অচেনা মানুষ। অথচ রাষ্ট্রের প্রতিটি বড় কাজেই এই বাহিনীর উপস্থিতি অপরিহার্য। ভিডিপি ছাড়া শরদীয় দুর্গাপূজার নিরাপত্তা হয় না, নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, রেল চলে না, দুর্যোগে মানুষ বাঁচে না। অথচ তারা নিজের খরচে কাজ করে, নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়। এটা কি স্বেচ্ছাসেবকতার নাম, নাকি রাষ্ট্রীয় শোষণের এক আধুনিক রূপ? বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সময় এসেছে ভিডিপিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার। এটি শুধু স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী নয়, বরং দেশের নিরাপত্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার “অঘোষিত সরকারি বাহিনী”।
তাদের “আংশিক বেতনভুক্ত মাঠপর্যায়ের নিরাপত্তা বাহিনী” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। মাসিক সম্মানী, দায়িত্বকালীন বীমা, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ ও পরিবারের জন্য সহায়তা এগুলো আইনি কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন যে বাহিনীর কাঁধে ভর করে নির্বাচন হয়, দুর্গাপূজায় শান্তি থাকে, রেল চলে, দুর্যোগে মানুষ বাঁচে তাদের কেন আজও তুচ্ছ ভাবা হয়? কেন বাজেট পাশ হয়, কিন্তু প্রাপ্য টাকা পৌঁছায় না মাঠের সৈনিকদের হাতে? কেন ভিডিপির মৃত্যুতে পতাকা নামানো হয় না, কেন তাদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায় না? ভিডিপিরা এই দেশের মাঠের মানুষ, তারা বেতন না পেলেও কাজ করে, কারণ তারা জানে তাদের কাজেই রাষ্ট্র টিকে আছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় রাষ্ট্র কি একদিন এই সত্যটা স্বীকার করবে? নাকি ভিডিপির ঘামে ভেজা মাটি থেকেই আবারও জন্ম নেবে অবহেলার নতুন অধ্যায়?
এই সাইটের সব ধরণের সংবাদ, আলোকচিত্র, অডিও এবং ভিডিও কন্টেন্ট কপিরাইট আইন দ্বারা সুরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই কন্টেন্ট ব্যবহারের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং আইনত শাস্তিযোগ্য। আমরা আমাদের ব্যবহারকারীদের একটি সুরক্ষিত ও তথ্যবহুল অভিজ্ঞতা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমাদের নিউজ সাইটের মাধ্যমে পাওয়া যেকোনো তথ্য ব্যবহারের আগে দয়া করে সেই তথ্যের উৎস যাচাই করতে ভুলবেন না। আপনাদের সমর্থন এবং সহযোগিতা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। আমাদের সাথেই থাকুন, সর্বশেষ খবর এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে।
