একটি জাতি তথ্য দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো ভালো শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষা শুধু জিপিএ ৫. সার্টিফিকেট অর্জন অথবা চাকরি লাভের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পরীক্ষায় ভালো ফল করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বিষয় নয়। তাই পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান বাড়ছে না। সন্তান কতটা মানবিক জানসম্পন্ন হলো, কতটা সুশিক্ষিত হলো, সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। মোটা অর্থের বিনিময়ে অর্জিত শিক্ষায় দেশপ্রেম, অভয়া, সভ্যতা, মানবিক মূল্যবোধ আজ প্রায় বিলুপ্ত। সমাজে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের বড় অভাব। তাই আমাদের স্লোগান ‘কেবল নয় ফলাফলমুখী শিক্ষা: বিকশিত হোক মানবতার দীক্ষা’। যে শিক্ষা বিবেক, নৈতিকতা ও মানবতাবোধকে জাগ্রত করে না, তা প্রকৃত শিক্ষা নয়। কারণ নৈতিকতাবিবর্জিত বিদ্বান ব্যক্তি সমাজ সংখারে কিংবা সামাজিক মূল্যবোধের রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র-সর্বত্র আজ মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতা আর উদারতা প্রায় প্রিয়মাণ। সমাজ হয়ে পড়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বার্থপর ও অসহিষ্ণু। দৃষ্টি শুধু স্বার্থের চোখে নিবদ্ধ, মানবিকতার চোখ কার্যত অন্ধ। আমাদের তরুণ সমাজের কাছে আজ সবচেয়ে বড় সংকট অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের। কাকে অনুসরণ করে স্বপ্ন বুনবে, কার চরিত্র অনুকরণ করবে, কার আদর্শে নিজেকে আলোকিত করবে, তার কোনো সমাধান নেই। তাই আমরা দেখতে পাই নৈতিকতাবিবর্তিত এ সমাজে বড় অপরাধীরা মূলত বড় বড় ডিগ্রিধারী ও উচ্চশিক্ষিত। একজন মানুষের চিন্তা, কর্ম, আচরণের প্রভাবের সৃতিকাগার হচ্ছে পরিবার। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, নীতিনৈতিকতা কিংবা অন্যের মতামত গ্রহণ করার মতো মানসিকতার শিক্ষা পরিবার থেকেই নিতে হয়। শিশুর প্রথম শিক্ষালয় তার পরিবার এবং প্রথম শিক্ষক তার মা-বাবা। সেহেতু শিশুকে পারিবারিক মূল্যবোধ, উন্নত চরিত্র, সৎ আদর্শবান নাগরিক ও উন্নত চরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে পরিবার। তাই শিশুদের নৈতিকভাবে বিকশিত করতে হলে পরিবারের সদস্যদের নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন হতে হবে। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় মানুষ যেমন নিজেকে নিয়ে ব্যয়, তেমনি ধ্যান-ধারণা ও চিন্তায় এসেছে নানা পরিবর্তন। কিন্তু আমরা যদি নিজেরাই স৩৩। ও নৈতিকতার মূর্ত প্রতীক কিংবা সহানুভুতির প্রতিচ্ছবি না হতে পারি, তবে তাণ প্রজম্মাকে সঠিক পথে পরিচালিায় কনরা কিংবা উন্নত মানুষ গড়া প্রায় অসম্ভব। বাবা-মা এবং অভিভাবকরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে সার্টিফিকেটদবজ শিক্ষায় প্রলুব্ধ করছে। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তারা লিপ্ত। কার ছেলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী হলো, কার ছেলে কোন দেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেল, এসবই আলোচনার বিষয়বস্তু। কিন্তু নীতিনৈতিকতা, মানবিকতা, দেশপ্রেম কিংবা সত্যিকারের মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার বিষয়ে কোনো ধরনের আলোকপাত নেই।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে পরিচিত। একজন ভালো চরিত্রের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সমাজের শ্রদ্ধার পাত্র। মানুষ আশা করে একজন শিক্ষক হবেন মহানুভব, কর্তব্যনিষ্ঠা। মানবিক মূল্যবোবের এসব গুণাবলি সমাজ জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। এ ধরনের শিক্ষক হয়ে ওঠেন সত্যিকারের গুর। শিক্ষক ছাত্রকে শুধু শিক্ষা নয়, সঙ্গে দেন দীক্ষাও। কারণ শিক্ষকদের দায়িত্ব শুধু পাঠদান, সিলেবাসের প্রশ্ন শেখানো কিংবা পরীক্ষায় পাস করানো নয়। বরং শিক্ষার্থীদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ, উন্নত চরিত্র গঠন করে প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রেরণা দেওয়া। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, এসব যেন আমরা আজ ভুলতে বয়েছি। আজ শিক্ষকরা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একে অন্যের বিরুদ্ধে দলাদলি, কোন্দল, মামলাবাজিতে লিপ্ত। শিক্ষার্থীদের তারা লেলিয়ে দিচ্ছেন পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ-মিছিলে। এমনকি অনেক শিক্ষক নামধারী আজ শিক্ষার্থীদের সামনেও মারামারি, হাতাহাতিতে লিপ্ত হচ্ছেন। অনৈতিকতার কারণে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষকরা। অনেক শিক্ষক হয়ে পড়েছেন বাণিজ্যমুখী। তাই ক্লাসের থেকে কোচিং-প্রাইভেটেই মনোযোগ বেশি। বিদ্যা আজ বাক্সবন্দি, পড়াশোনা শুধু পরীক্ষামুখী। বিদ্যালয়গুলো এখন শুধু পাসের হার, গ্রেড আর নম্বরের পেছনে ছোটাছুটি। কী শেখানো হচ্ছে আর কী শেখানো দরকার, তা নিয়ে কোনো আয়োজন নেই। নেই কোনো লাগসই পরিকল্পনা। শিক্ষার্থীরা আজ অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যেমন আপন করে ভাবতে পারছেন না, তেমনি শিক্ষাপ্রতিঠানগুলোও আগ্রহ বা আকর্ষণের জাজদা হিসেবে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না। পড়ালেখা যেন তাদের কাছে একবরনের বাধ্যবাধকতা, সার্টিফিকেট প্রাপ্তিই এর মূল উদ্দেশ্য। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পরীক্ষার আগে ও পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপ, হতাশা ও ক্লান্তি এমনভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, তারা কখনো কখনো পরীক্ষাকেন্দ্র ভাঙচুরের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় লিপ্ত হচ্ছেন। এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নৈতিক ও মানসিক দুর্বলতার প্রতিফলন। এ কারণেই শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধের স্থানটি আজ অনেকটা বিবর্ণ। ছাত্রসমাজের সামনে আজ অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিতের বড় অভাব। মানসম্মত শিক্ষক না থাকায় মানসম্মাত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশ আজ শুধু অতীত স্মৃতি। সমাজে আজ আদর্শবান ব্যক্তির অভাব, বিত্তবানরাই যেন আদর্শ আর পেশিশক্তির অধিকারীরাই যেন সমাজপতি। তাই সমাজ আর গড়ে উঠছে না, উঠছে সাম্রাজ্য। চাকরি পাওয়া বা আর্থিকভাবে সচ্ছলতা আনতেই ব্যয় মুখস্থনির্ভর আজকের শিক্ষা-সংস্কৃতি। ফলে বিভবৈভব আর প্রাচুর্যে জীবনকে বাড়িয়ে তোলার প্রবল বাসনায় ব্যক্তি বা সমাজের জন্য মহৎ কিছু করার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের মূল চালিকাশক্তি-সততা ও নিষ্ঠার মতো মানবিক গুণাবলি।
আমরা যদি সত্যিই একটি উন্নাত, মানবিক ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, ভবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে হতে হবে। আনন্দময় এবং আশগ্রহণমূলক। যে শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক মানদণ্ডকে উন্নত করার পাশাপাশি তার ভেতরকার মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকবে উৎসবমুখর পরিবেশ। শিক্ষকরা হবেন সর্বার অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, অভিভাবকদের লক্ষ্য শুধু ভালো ফল নয়; লক্ষ্য হবে আদর্শ মানুষ গড়ার। যারা হবে মেধাবী, মানবিক, নৈতিকতাবোধসম্পন্ন ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক প্রজন্ম। যেখানে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে থাকবে না কেনো ভয়, থাকবে না কোনো শঙ্কা। সম্পর্কের ভিত্তি হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। প্রযুক্তির পরিবর্তনকে আলিঙ্গন এবং প্রযুক্তির মতো উন্নত সংস্করণে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে যোগ্যতার মানদণ্ডে উন্নীত হবে। তাহলেই আগামী প্রজখোর কাছে এ দেশ থাকবে নিরাপদ। অর্জিত হবে কাঙ্ক্ষিত ব্যংলাদেশ।
লেখকঃ জেলা প্রশাসক, নারায়ণগঞ্জ।
এই সাইটের সব ধরণের সংবাদ, আলোকচিত্র, অডিও এবং ভিডিও কন্টেন্ট কপিরাইট আইন দ্বারা সুরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই কন্টেন্ট ব্যবহারের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং আইনত শাস্তিযোগ্য। আমরা আমাদের ব্যবহারকারীদের একটি সুরক্ষিত ও তথ্যবহুল অভিজ্ঞতা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমাদের নিউজ সাইটের মাধ্যমে পাওয়া যেকোনো তথ্য ব্যবহারের আগে দয়া করে সেই তথ্যের উৎস যাচাই করতে ভুলবেন না। আপনাদের সমর্থন এবং সহযোগিতা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। আমাদের সাথেই থাকুন, সর্বশেষ খবর এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে।